শরীরে যে কোনও কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বলা হয় টিউমার। ব্রেন টিউমার হল মস্তিষ্কের কোনও কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। যখন মাথায় এই টিউমার বৃদ্ধি পায় তখন মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বেড়ে যায় যা মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সঠিক সময়ে ব্রেন টিউমার চিকিৎসা প্রয়োজন। ব্রেইন টিউমার হওয়ার কারণ এখনো অজানা । তবে দেখা গেছে, কিছু ছোট টিউমার আছে যা জীনগত ত্রুটির ফলে একই পরিবারের মধ্যে অনেকের ব্রেইন টিউমার হওয়ার কারণ ।
মস্তিষ্কের মধ্যে কোনও কারণে বিভিন্ন কোষ জটি পাকিয়ে গেলে সেখান থেকেও কিন্তু হতে পারে ব্রেন টিউমার। ব্রেন টিউমারের অনেক রকম প্রকার ভেদ রয়েছে। কিছু থাকে ম্যালিগন্যান্ট, কিছু থাকে নন ক্যানসার। তবে ব্রেন টিউমারের লক্ষণ কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সমান নয়।
বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিকের বেশি মানুষের ব্রেন টিউমার ধরা পরে। এমনকি সেকেন্ডারি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিকের বেশি হয়ে থাকে।
ব্রেন টিউমার দুই রকমের হতে পারে। বিনাইন বা শিষ্ট টিউমার ও ম্যালিগন্যান্ট বা দুষ্টু টিউমার। কিছু ব্রেন টিউমারের হয় শরীরের অন্য কোনো স্থানের টিউমার থেকে। এটাকে সেকেন্ডারি বা মেটাস্টাটিক ব্রেন টিউমার বলা হয়। কিছু সংখ্যক ব্রেন টিউমার হলো নন-ক্যানসারাস (ক্ষতিকর নয়) এবং কিছু সংখ্যক টিউমার হলো ক্যানসারাস (মারাত্মক ক্ষতিকর)। সেকেন্ডারি টিউমার হলো ক্যানসারাস, যা শরীরের যেকোন স্থানে দেখা দেয় এবং মস্তিষ্ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।
ব্রেন টিউমারের লক্ষণ
ব্রেন টিউমারের সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা। আর তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। মাথা ব্যাথার সঙ্গে কিছুক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তিতেও সমস্যা হয়। এছাড়াও হঠাৎ মাথায় চাপ অনুভব করা, সকালের দিকে তীব্র মাথা ব্যথা, ঘুম থেকে ওঠার সময় মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাব, ডবল ভিশন এই সব সমস্যাও থাকে।
টিউমারের অবস্থানের উপর নির্ভর করে বাকি সব সমস্যা আসে। খিঁচুনি, চোখের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, কথা বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া, চোখে ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, ভারসাম্যহীনতা, অস্বাভাবিক আচরণ, স্মৃতিলোপ, বার বার ভুলে যাওয়া এই সমস্ত কিছুই হতে পারে ব্রেন টিউমারের লক্ষণ। ব্রেন টিউমার যদি তার আয়তনের তুলনায় বড় হয়ে যায় তখন তা চাপ ফেলে মস্তিষ্কে। আর টিউমার খুলির মধ্যে থাকায় তা প্রসারণের জন্য জায়গা পায় না। এভাবেই টিউমার মস্তিষ্কের উপর চাপ দিতে থাকে। যে কারণে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, দৃষ্টিশক্তি হারানো এবং কিছুসময় রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনির মত সমস্যা হলে চিকিৎসকেরা প্রথমেই ব্রেনের স্ক্যান এবং এমআরআই করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। টিউমারের অবস্থান নির্নয় করতে এবং অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা বুঝতেই আগে এই সব পরীক্ষা করতে হবে।
ব্রেন টিউমারের ঝুঁকিতে কারা আছেন? এ রকম করে কাউকে নির্দিষ্ট করা যায় না। যেকোন মানুষ ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হতে পারেন।
ব্রেন টিউমার নির্ণয়
ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে যথাসম্ভব দ্রুত নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগ নির্ণয়ে নিচের পরীক্ষাগুলো সহায়ক:
ব্রেনের সিটিস্ক্যান ও এমআরআই
স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখার জন্য ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি বা ইইজি
স্নায়ুতন্ত্রের পরিবহন ক্ষমতা বা নার্ভ কন্ডাকশন টেস্ট বা ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি
সিটি গাইডেড এফএনএসি
তবে এমআরআই পদ্ধতি সব থেকে আধুনিক এবং ব্রেন টিউমার নির্ণয়ের জন্য উন্নত পরীক্ষা।
চিকিৎসা
সাধারণত ব্রেন টিউমার হলে অপারেশনের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই সিদ্ধান্ত একান্তই চিকিৎসকের। টিউমারের আকার, অবস্থান, সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য শারীরিক অবস্থা বিচার করে তবেই অপারেশনের দিকে এগোন চিকিৎসকেরা। সব সময় যে সার্জানির প্রয়োজন হয় এমনও নয়। কাজ হয় ওষুধের। আবার অপারেশনের পর অনেকের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি থাকে। সব কিছুই নির্ভর করে স্বাস্থ্যের উপরে।
যেভাবে ব্রেন টিউমারের হাত থেকে নিরাপদ থাকা যাবে
প্রথমেই বলা হয়েছে যে, ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সঠিক কারণ এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু সাধারণ নিয়ম ও স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা ব্রেন টিউমারকে দূরে রাখতে কাজ করবে বলে বিশ্বাস করে বিশেষজ্ঞরা। যার মাঝে রয়েছে-
ক্যানসার প্রতিরোধী খাবার গ্রহণ
প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান থেকে ক্যানসার বিরোধী উপাদান পাওয়া যায়। আপেল, আঙ্গুর, ব্রকলি, গাজরের মতো উপকারী এই সকল খাদ্য উপাদানগুলোকে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে।
মোবাইলের সীমিত ব্যবহার
মোবাইল ফোন থেকে নিঃসৃত রশ্মি ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সম্ভবনাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই মোবাইল ফোন যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে।
ধূমপান বর্জন করা
সন্দেহাতীতভাবে এই বিষয়ে একমত পোষণ করতেই হবে। ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এছাড়া ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে এই বদ অভ্যাসটি।
এছাড়া নিয়মিত শরীরচর্চা করা, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি মূলক কাজ করা (ধাঁধা কিংবা গণিত সমাধান), মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, উপোরক্ত লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি বিকাশের ফলে উন্নত পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই মস্তিষ্কের টিউমার নির্ণয় করা যায়। সম্পূর্ণ ও সঠিক চিকিৎসায় অনেক রোগীই সুস্থ হয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।